সুতা তৈরি ও বুনন

অষ্টম শ্রেণি (দাখিল) - গার্হস্থ্য বিজ্ঞান - পোশাক-পরিচ্ছদ ও কর | | NCTB BOOK

পাঠ ১ - সুতা তৈরির সাধারণ পদ্ধতি

আমরা যে পোশাক পরিধান করি তা মূলত প্রস্তুত করা হয় বস্ত্র থেকে। এই বছর বুনন, নিটিং, ফেন্টিং, বন্ডিং,
ব্রেইডিং ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা হয়। সুতা হচ্ছে বুনন বা নিটিং প্রক্রিয়ার মূল উপকরণ। তোমরা
কি জানো কীভাবে এই সুতা উৎপাদন করা হয়। এই পাঠে আমরা সুতা তৈরির সাধারণ পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু
ধারণা লাভ করব।

সুতা তৈরির সাধারণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানার আগে আমাদের জানতে হবে যে সুতা তৈরির মূল উপাদান কী?
সুতার মূল উপাদান হচ্ছে তন্তু। এই সুতা উৎপাদনে যে তত্ত্ব ব্যবহার করা হয় তা প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তন্তু
হতে পারে আবার প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম তন্তুর মিশ্রণেও সুতা তৈরি করা যেতে পারে। কমপক্ষে আধা ইঞ্চি বা
তার চেয়ে বড় অসংখ্য আঁশের সমন্বয়ে সুতা উৎপাদনের বিষয়টি সত্যই বিস্ময়কর। এরূপ তন্তু সমানভাবে লম্বা
করে একত্রে পাক বা মোচড় দিলে সুতা উৎপাদিত হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে বত্র উৎপাদনের জন্য একগুচ্ছ
তত্ত্বকে পাক বা মোচড় দিয়ে একত্রে সন্নিবেশ করে যা তৈরি করা হয় তাই সুতা।

দেখা গেছে যে সুতা উৎপাদনের সময় যদি তত্ত্বতে বেশি পাক বা মোচড় দেওয়া হয় তাহলে সেই সুতা বেশি শত্রু
হবে, কম উজ্জ্বল হবে, দৈর্ঘ্যে কমে যাবে এবং এক পর্যায়ে ছিড়ে যাবে।

তোমরা খেয়াল করবে যে কিছু কিছু কাপড় আছে মোটা ও খসখসে প্রকৃতির। দেখা গেছে যে, এ ধরনের
কাপড় তৈরিতে যে সুতা ব্যবহার করা হয় তা ছোট আঁশ বা তন্তু থেকে উৎপাদিত। অন্যদিকে লম্বা তন্তু থেকে
উৎপাদিত সুতা মসৃণ ও উজ্জ্বল হওয়ায় এরূপ সুভার তৈরি করও মসৃণ ও উজ্জ্বল প্রকৃতির হয়ে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে তন্তু থেকে সুতা তৈরির কোনো নির্দিষ্ট একটি পদ্ধতি নেই। বিভিন্ন তন্তুর জন্য সুতা তৈরির
পদ্ধতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তুলা, ফ্ল্যাক্স, পশম ইত্যাদি তন্তুর ক্ষেত্রে সুতা তৈরির প্রথম পর্যায় হচ্ছে
কার্ডিং। কার্ডিং করার সময় তন্তু থেকে ধুলা, বালি, আলগা ময়লা এবং অতিরিক্ত খাটো তন্তুগুলো দূরীভূত হয়।

সুতা তৈরির দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে কম্বিং। মোটা সুতা বা কাপড়ের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির প্রয়োজন নাই। কিন্তু খুব
মিহি ও মসৃণ সুতা বা কাপড়ের ক্ষেত্রে তন্তু থেকে অতিরিক্ত খাটো তন্তুগুলো বাদ দেওয়ার জন্য কার্ডিং এর পর
কম্বিং করতে হয়। ফলে অবশিষ্ট উপযুক্ত দৈর্ঘ্যের তন্তুগুলো একটি পাতলা আস্তরণে রূপান্তরিত হয়। এই
পাতলা আস্তরণকে স্লাইভার বলে।

ফ্ল্যাক্স বা লিনেন সুতার ক্ষেত্রে কম্বিং প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয় না। এর পরিবর্তে কম্বিং এর অনুরূপ যে প্রক্রিয়াটি
প্রয়োগ করা হয় তাকে বলে হেকলিং। খুব মিহি সুতা পেতে হলে লিনেনের তত্ত্বগুলোকে লম্বা হতে হয় এবং
স্লাইভারে তন্তুর অবস্থান সমান্তরাল হতে হয়। তাই এমন সুতার জন্য লিনেনে অনেক বেশি হেকলিং এর
প্রয়োজন হয়।

রেশমের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি লম্বা তন্তুকে একত্র করে পেঁচিয়ে রাখা হয়। এই পেঁচানোকে রিলিং বলে।
এভাবে কয়েকটি তত্ত্বকে একত্রীকরণ ও মোচড়ানোকে বলা হয় থ্রোয়িং।

তন্তু থেকে সুতা তৈরির সবশেষ পর্যায় হচ্ছে স্পিনিং। এ ধাপের পূর্বে রোডিং প্রক্রিয়ায় তন্তুর পাতলা আস্তর বা
স্লাইভারকে টেনে আরও সরু করা হয় এবং পরবর্তীতে পাক বা মোচড় দিয়ে সুতায় পরিণত করা হয়। স্লাইভার
মোচড় দেওয়ার ফলে তন্তুগুলো একে অপরের সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে সুতার রূপ ধারণ করে। রেয়ন, নাইলন
ইত্যাদি কৃত্রিম তন্তুতেও পাক বা মোচড় দেওয়া হয়। দেখা গেছে যে ছোট তন্তুতে বড় তন্তুর তুলনায় বেশি পাক
বা মোচড় দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সাধারণত মোচড়ের পরিমাণ বেশি হলে সুতাটি বেশি শক্ত হয়। তবে
মাত্রাতিরিক্ত মোচড়ের ফলে সুতা ছিঁড়ে যেতে পারে। মূল ভঙ্গুর দৈর্ঘ্য ও গুণাগুণ ভেদে সুতা কাটার সময়
মোচড়ের পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে।

পাঠ ২- বুনন

আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পারব যে আমাদের মায়েরা যে শাড়ি, ব্লাউজ পরিধান করে সেই
কাপড়ের সাথে আমাদের সালোয়ার, কামিজ কিংবা শার্ট, প্যান্ট-এর কাপড়ের প্রকৃতি এক নয়। এর কারণ
কী বলতে পারবে? বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বস্ত্র উৎপাদন পদ্ধতি। আমরা
ইতোমধ্যে জেনেছি যে বস্ত্র বিভিন্ন উপায়ে উৎপাদন করা যায়। এই বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত
পদ্ধতিটি হচ্ছে বুনন ।

যে যন্ত্রের সাহায্যে বুনন প্রক্রিয়ায় কর উৎপাদন করা হয়
তাকে বলে তাঁত। এই তাঁত হস্ত চালিত বা বস্ত্ৰ চাপিত
হতে পারে। তাঁতের মধ্যে এক সেট সুতা লম্বালম্বিভাবে
সাজানো থাকে, যাকে টানা বা ওয়ার্ন বলে। এই টানা
সুতার ভিতর দিয়ে আরও এক সেট সুতা আড়াআড়িভাবে
চালনা করে কত্র উৎপাদন করা হয়। মাকু নামক একটি
যন্ত্রের সাহায্যে আড়াআড়িভাবে চালিত এই সুতাকে
পড়েন বা ওয়েট বলে। কাজেই আমরা বুঝতে পারছি।
যে তাঁতের সাহায্যে টানা ও পড়েন সুতার পারস্পরিক
সমকৌণিক বন্ধনকেই বুনন বলে।

হস্ত চালিত তাঁত

দেখা গেছে যে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র উৎপাদনের জন্য বয়ন পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই মৌলিক বুননকে
তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা-সাদাসিধা বুনন, টুইল বুনন, সাটিন ও স্যাটিন বুনন।

ক. সাদাসিধা বুনন- আমরা বাজার থেকে যেসব শংখ,
ওয়েল, পপলিন কাপড় কিনে থাকি সেগুলো মূলত
সাদাসিধা বুনন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়। এই বুননের
মাধ্যমে গামছা, লুঙ্গি, তাঁতের শাড়ি ইত্যাদিও তৈরি করা
হয়। বা বয়ন পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে সহজ বুনন
হচ্ছে এটি। এই বুননে একটি পড়েন সুতা একটি টানা
সুতার উপর নিচ দিয়ে অতিক্রম করে। বুননে টানা ও
পড়েন সুতাগুলো অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করে, ফলে
কাপড় খুব মসৃণ ও টেকসই হয় এবং কাপড়ের
উপরিভাগ রং করা ও ছাপার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী
হয়। এ ধরনের কাপড় ময়লা হলে চোখে পড়ে এবং
সহজেই পরিষ্কার করে নেওয়া যায়।

 

 

 

খ. টুইল বুনন- আমরা জিন্স, ড্রিল, গ্যাবার্ডিন ইত্যাদি যে বসের পোশাক
পরিধান করি তাই টুইল বুননের কর। এই বুননে পড়েন সুতা টানা সুতার
মধ্য দিয়ে এমনভাবে চলাচল করে যে কাপড়ের উপরিভাগে কোনাকুনি
একটি ডাব ফুটে উঠে, ভাই একে তেরছা বুননও বলে। এই বুননের কাপড়
বেশ মজবুত হয়। ময়লা পড়লে সহজে বোঝা যায় না। তবে যখন বোঝা
যায় তখন ময়লা পরিষ্কার করা সাদাসিধা বুননের মতো সহজসাধ্য হয়
না।
গ. সাটিন ও স্যাটিন বুনন- তেরছা বুননের মতো সাটিন ও
স্যাটিন বুননে শিররেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে না। সাটিন
বুননের সময় পড়েন সুতাটি একটি টানা সুতার উপর এবং
চারটি বা তার অধিক টানা সুতার নিচ দিয়ে চলাচল করে।
অন্যদিকে স্যাটিন বুননে পড়েন সুতাটি একটি টানা সুতার
নিচ এবং চারটি বা তার অধিক টানা সুতার উপর দিয়ে
চলাচল করে। এই দুই ধরনের বুননেই টুইলের মতো
অবিচ্ছিন্ন কর্ণ না থাকায় কাপড়ের উপরিভাগ মসৃণ ও উজ্জ্বল দেখায়। এই বুননের কাপড় দিয়ে সাধারণত
সালোয়ার, কামিজ, পাঞ্জাবি, পায়জামা, ফ্রক, পর্দার কাপড়, বিছানার কভার, সজ্জামূলক পোশাক ইত্যাদি তৈরি
হয়। এ ছাড়া কোট, স্যুট ও সেরওয়ানীর কাপড়ের লাইনিং-এর জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই বুননে কাপড়ের
উপরিভাগে বেশিরভাগ সুতা ভাসমান অবস্থায় থাকে, তাই সচরাচর ব্যবহারের জন্য এ ধরনের কাপড়
উপযোগী নয়।

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১। তন্তু থেকে সুতা তৈরির সর্বশেষ পর্যায় কোনটি?

(ক) নিটিং

(খ) বন্ডিং

(গ) স্পিনিং

(ঘ) গ্লোয়িং

২। নিচের কোন তন্তু থেকে সুতা তৈরির সময় বেশি পাক দিতে হয়?

(ক) রেশম

(ঘ) নাইলন

(গ) তুলা

নিচের অনুচ্ছেদটি মনোযোগ দিয়ে পড় এবং ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও ।

টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার আপনান সাহেব একটি স্পিনিং মিলে চাকরি করে। সেখানে সে তোয়ালে, গামছা,
বিছানার চাদর ইত্যাদির জন্য সুতা তৈরি করার সময় প্রথমেই তন্তুকে কার্ডিং করে নেন।

৩। আদনান সাহেব কোন তন্তু দিয়ে সুতা তৈরি করেন?

(ক) রেশম

(খ) নাইলন

(গ) পশম

(ঘ) তুলা

৪। এই তত্ত্ব থেকে পরিধেয় বস্ত্রের জন্য সুতা তৈরি করতে কার্ডিং-এর পর আদনান সাহেব কী করবেন?

কম্বিং

(খ) হেকলিং

(গ) রিলিং

(ঘ) স্পিনিং

সৃজনশীল প্রশ্ন

(ক) বুনন কী?

খ) সুতা বলতে কী বোঝায়?

(গ) ১নং চিত্রের বয়ন পদ্ধতিতে তৈরি কাপড় ময়লা হলে পরিষ্কার করা সহজ। ব্যাখ্যা কর।

(ঘ) তুমি কি মনে কর ১ ও ২ নং উভয় চিত্রের বয়ন পদ্ধতির কাপড় ছাপা নকশার জন্য উপযোগী?
উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও ।

 

 

 

Content added By
Promotion